সংঘদান

তৃতীয় শ্রেণি (প্রাথমিক স্তর ২০২৪) - বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - | NCTB BOOK

সংঘদান

এ অধ্যায়ে যা আছে - 

• সংঘ ও সংঘদান 

• সংঘদানের উপকরণ 

• সংঘদানের উৎসর্গগাথা 

• সংঘদানের সুফল 

• দান কাহিনি

অংশগ্রহণমূলক কাজ-২৩: জোড়ায় কাজ

তালিকা তৈরি: উপরের চিত্রটি মনোযোগ দিয়ে দেখি এবং দলে আলোচনা করে চিত্রে দেওয়া দানীয় বস্তুর একটি তালিকা তৈরি করি

দানীয় বস্তুর তালিকা

 

সংঘ ও সংঘদান

বৌদ্ধধর্মে দানের গুরুত্ব অপরিসীম। দান পারমী পূর্ণ না করলে নির্বাণ লাভ সম্ভব নয়। দান করা একটি মহৎ গুণ এবং একটি সেবামূলক কাজ। নিঃস্বার্থভাবে অপরকে যা দেয়া হয় তা-ই দান। ধনী-গরিব সবাই দান করতে পারেন। অনেক দরিদ্র ব্যক্তি দান করে মহৎ বা স্মরণীয় হয়েছেন। যেকোনো সময় যেকোনো ব্যক্তিকে দান করা যায়। তবে ভিক্ষুসংঘকে দান করাই হচ্ছে উত্তম দান। দানের নানা উপকারিতা রয়েছে। দানের দ্বারা চিত্ত পরিশুদ্ধ হয়। লোভ দূর হয়। ইহকাল ও পরকাল সুখের হয়। দুস্থ, অসহায় ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হয়। দান স্বর্গের সোপান বা সিঁড়ি। তাই সকলের দান চর্চা করা একান্ত উচিত।

বৌদ্ধধর্মে নানা প্রকার দানানুষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে সংঘদান, অষ্টপরিষ্কার দান এবং কঠিন চীবর দান অন্যতম। আজকের পাঠে আমরা সংঘদান সম্পর্কে জানব।

সংঘদান সম্পর্কে জানার পূর্বে আমরা প্রথমে 'সংঘ' কী তা জানব। 'সংঘ' শব্দের অর্থ হলো দল, সমিতি, সভা ইত্যাদি। পাঁচজন বা তার অধিক ভিক্ষুকে একত্রে ভিক্ষুসংঘ বলা হয়। সাধারণত ভিক্ষুসংঘকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধার সাথে যে দান দেওয়া হয়, তাকে সংঘদান বলে। যেকোনো সময় বিহারে বা গৃহে সংঘদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়। তবে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে সেই পরিবারে অবশ্যই সংঘদান আয়োজন করতে হয়। এছাড়া, বিবাহ অনুষ্ঠান, নতুন বাড়ি-ঘর নির্মাণ, নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু, সন্তান জন্ম এবং যেকোনো শুভ কাজ উপলক্ষে সংঘদান আয়োজন করা যায়। সংঘদান অনুষ্ঠানে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। ভিক্ষু ও নিমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য সাজানো হয় পৃথক আসন। ভিক্ষুসংঘ আসন গ্রহণের পর উপস্থিত সকলে সাধুবাদ দিয়ে তাঁদের স্বাগত জানান। ভিক্ষুসংঘ এবং অতিথিগণ আসন গ্রহণের পর সংঘদানের কার্যক্রম শুরু হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য বয়োজ্যেষ্ঠ একজন ভিক্ষুকে সভাপতি নির্বাচন করা হয়। তিনি সংঘদান অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেন। উপস্থিত দায়ক-দায়িকা হতে একজন প্রথমে পঞ্চশীল প্রার্থনা করেন। এরপরে সভাপতি বা তাঁর নির্দেশে একজন ভিক্ষু ত্রিশরণসহ পঞ্চশীল প্রদান করেন এবং সংঘদানের উৎসর্গগাথা আবৃত্তি করেন। উপস্থিত দায়ক-দায়িকাগণ ত্রিশরণসহ পঞ্চশীল গ্রহণ করেন এবং উৎসর্গগাথা আবৃত্তি করে দানীয় বস্তুসমূহ দান করেন। উপস্থিত অন্যান্য ভিক্ষুগণ সূত্রপাঠ এবং ধর্মদেশনা করেন। পরিশেষে ভিক্ষুসংঘ উপস্থিত সকলকে আশীর্বাদ প্রদান করে সংঘদান অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষণা করেন। দান শেষ হওয়ার পর দুপুর ১২ টার পূর্বে ভিক্ষসংঘকে উত্তম খাদ্যদ্রব্যে আপ্যায়ন করা হয়।

অংশগ্রহণমূলক কাজ-২৪: একক কাজ

শূন্যস্থান পূরণ: সঠিক শব্দ দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করি

ক. সংঘ শব্দের অর্থ হলো . . . . . . . . . . . . . . .  . . . . . . . . . . . . . . .  . . . . . . . . . . . . . . .  ইত্যাদি।

খ. পাঁচজন বা তার বেশি ভিক্ষুকে  একত্রে  . . . . . . . . . . . . . . . বলা হয়।

গ. যেকোনো সময়  . . . . . . . . . . . . . . . বা  . . . . . . . . . . . . . . . সংঘদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়।

ঘ. যেকোনো  . . . . . . . . . . . . . . . উপলক্ষ্যে সংঘদান আয়োজন করা যায়।

৬. উৎসর্গগাথা আবৃত্তি করে. . . . . . . . . . . . . . . . বস্তুসমূহ দান করেন।

সংঘদানের উপকরণ

সংঘদানে অনেক কিছুই দান করা যায়। সাধারণত সংঘদানে ভিক্ষুসংঘের নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু দান করা হয়। যেমন: টাকা, পয়সা, খাদ্য-দ্রব্য, চীবর, ঔষধ, পানীয়, বই, খাতা, কলম, পেন্সিল, তোষক, কম্বল, টিস্যু পেপার, সাবান, তোয়ালে, সুই-সূতা, গ্লাস, পানির পাত্র, চায়ের কাপ ইত্যাদি। সংঘদানে উৎসর্গ গাথা আবৃত্তি করে দানীয়বস্তুসমূহ দান করতে হয়। উৎসর্গ গাথাটি নিচে দেওয়া হলো

সংঘদানের উৎসর্গ গাথা

ইমং ভিক্সং সপরিস্থারং অনুত্তরং পুঞঞখেত্তং ভিক্ষু সঙ্ঘস্স দানং দেম পূজেম। দুতিযম্পি, ইমং ভিক্সং সপরিস্থারং অনুত্তরং পুঞঞখেত্তং ভিক্ষু সঙ্ঘস্স দানং দেম পূজেম। ততিযম্পি, ইমং ভিক্সং সপরিস্থারং অনুত্তরং পুঞখেত্তং ভিক্ষু সঙ্ঘস্স দানং দেম পূজেম।

বাংলা অনুবাদ:

আমরা এই প্রয়োজনীয় উপকরণ অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র ভিক্ষুসংঘকে দান দিয়ে পূজা করছি। উপস্থিত সকলকে গাথাটি সমস্বরে তিনবার আবৃত্তি করতে হয়।

অংশগ্রহণমূলক কাজ-২৫: দলগত কাজ

বাক্য লিখন: দলে আলোচনা করে নিজেদের দেখা সংঘদান সম্পর্কে ৫টি বাক্য লিখি

১.
২.
৩.
৪.
৫.

 অংশগ্রহণমূলক কাজ-২৬: একক কাজ

ভূমিকাভিনয়: সংঘদানের উৎসর্গ গাথাটি দলে আবৃত্তি করি

সংঘদানের সুফল

সকল ভালো কাজের সুফল আছে। তেমনি সংঘদানেরও সুফল আছে। ভিক্ষুসংঘ দানের উত্তম ক্ষেত্র। তাই ভিক্ষুসংঘকে দান দিলে অধিক সুফল লাভ করা যায়। বুদ্ধ সংঘদানের ফল সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন। সংঘদানের সুফল সম্পর্কে বুদ্ধ বলেছেন, "যুগে যুগে পৃথিবী, সাগর, মেরু ক্ষয় হয়ে যাবে। কিন্তু সংঘদানের সুফল বা পুণ্যরাশি ক্ষয় হবে না।"

এছাড়া, সংঘদানের আরো অনেক সুফল আছে। যেমন, সংঘদানের ফলে দাতা জন্ম-জন্মান্তরে ধনশালী হন। যশ-খ্যাতির অধিকারী হন। জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান হন। বিপদ-আপদ হতে রক্ষা পান। সর্বত্র প্রশংসিত ও সম্মানিত হন। রোগহীন হয়ে সুস্থ জীবনযাপন করেন। তাই নিজে দান করা এবং অন্যকে দান দিতে উৎসাহিত করা সকলের উচিত। উৎসাহিত করলে অনেক মানুষ দান দিতে আগ্রহী হয়। নিচে এরূপ একটি দান কাহিনি দেওয়া হলো।

অংশগ্রহণমূলক কাজ-২৭: দলগত কাজ

তালিকা তৈরি: দলে আলোচনা করে সংঘদানের সুফলের একটি তালিকা তৈরি করি

সংঘদানের সুফলের তালিকা

দান কাহিনি

 একবার বারাণসীতে জনগণের উদ্দেশ্যে কশ্যপ বুদ্ধ দান সম্পর্কে বলেছিলেন, 'উপাসকগণ! এ জগতে অনেক ব্যক্তি আছেন যারা নিজে দান দেন, কিন্তু অন্যকে দান দিতে উৎসাহিত করেন না। এর ফলে তারা নিজেরা পুণ্য সম্পদ লাভ করেন, কিন্তু একটি সুন্দর পরিবার লাভ করেন না। আবার অনেক ব্যক্তি আছেন, যারা নিজে দান করেন না, কিন্তু অন্যকে দান দিতে উৎসাহিত করেন। এর ফলে তারা পরিবার লাভ করেন, কিন্তু পুণ্য সম্পদ লাভ করেন না। অনেক ব্যক্তি আছেন যারা নিজে দান করেন না এবং অন্যকেও দান দিতে উৎসাহিত করেন না। তারা কোনো সম্পদই লাভ করেন না। তারা দরিদ্র জীবনযাপন করেন। অনেক ব্যক্তি আছেন যারা নিজে দান করেন এবং অন্যকেও দান দিতে উৎসাহিত করেন। তাঁরা পুণ্য সম্পদ, সুন্দর পরিবার, যশ-খ্যাতি এবং সকলের ভালোবাসা লাভ করেন।'

এ কথা শুনে বারাণসীর এক পণ্ডিত ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি এমন ভাবে দান করবেন- যাতে তার উভয় সম্পত্তি লাভ হয়। তিনি কশ্যপ সম্যক সম্বুদ্ধকে বিশ হাজার ভিক্ষুসহ নিমন্ত্রণ জানালেন। কশ্যপ বুদ্ধ তার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। এরপর গ্রামের সকলকে বিষয়টি জানালেন। সকলকে অনুরোধ করলেন সবাই যেন যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী এ দান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। গ্রামের প্রত্যেকে আগ্রহের সাথে অংশগ্রহণ করলেন। কিন্তু 'মহাদুর্গত' নামে একজন অংশগ্রহণ করলেন না। তিনি বললেন, তার অনেক অভাব আছে। তার পক্ষে দিন মজুরি করে ভিক্ষুদের আহারের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। কিন্তু পণ্ডিত ব্যক্তি তাকে বললেন, আপনি দিন মজুরি করে আগে দান করতে পারেননি বলে যশ-খ্যাতি ও ভালোবাসার অভাব বোধ করছেন। এ কথা কী আপনি বুঝতে পারছেন? আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী দান করা উচিত নয় কী?'

তখন 'মহাদুর্গত' বুঝতে পারলেন তার দান দেয়া উচিত। তখন তিনি একজন ভিক্ষুকে দান দেয়ার জন্য মন স্থির করলেন।

এরপর মহাদুর্গত ও তার স্ত্রী একজন ভিক্ষুকে দান দেবার জন্য দিন মজুরি করতে গেলেন। তাদের এই সিদ্ধান্তে গ্রামের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ খুশি হয়ে তাদের কাজ দিলেন। কাজ করে তারা মজুরি ও বিভিন্ন সামগ্রী পেলেন। তা দিয়ে তাঁরা একজন ভিক্ষুর খাবারের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু এদিকে পণ্ডিত ব্যক্তি মহাদুর্গতের জন্য একজন ভিক্ষুকে নিমন্ত্রণ করে রাখতে ভুলে যান। একথা জেনে মহাদুর্গত খুব মনোকষ্ট পেলেন। তখন সকলে তাকে বুদ্ধি দিল সম্যক সম্বুদ্ধের কাছে গিয়ে অনুরোধ করতে যেন তিনি তার দান গ্রহণ করেন। মহাদুর্গত সকলের পরামর্শে কশ্যপ বুদ্ধের কাছে গিয়ে অনুরোধ করলেন। কশ্যপ বুদ্ধ মহাদুর্গতের পরিশ্রম, ভক্তি ও শ্রদ্ধা দেখে তার দান গ্রহণ করলেন। তখন সেখানে উপস্থিত অনেক ধনী ব্যক্তি তাকে অনেক ধন-সম্পদের লোভ দেখিয়ে বললেন, 'মহাদুর্গত! তুমি অন্যান্য ভিক্ষুদেরও দান দাও। আমরা তোমাকে অনেক ধন-সম্পদ দেব।' কিন্তু মহাদুর্গত তাঁদের ধন-সম্পদের প্রতি কোনো লোভ করলেন না। তিনি নিজের পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ দ্বারা দান দিতে মনস্থির করলেন। তা দেখে গ্রামবাসীরা তাকে সম্মান দেখালেন। শ্রদ্ধার আসনে বসালেন। আজ আমরা এ কাহিনির মাধ্যমে বুঝতে পারি, অন্যকে ভালো কাজে উৎসাহিত করে ভালো কাজ করানো যায়।

অংশগ্রহণমূলক কাজ-২৮: একক কাজ

বাক্য লিখন: নিজের দেখা সংঘদান সম্পর্কে নিচে ৫টি বাক্য লিখি

 
 
 
 
 
 
Content added By
Promotion